সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বাগেরহাটের এই ক্ষমার ঘটনা
সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বাগেরহাটের এই ক্ষমার ঘটনা!!
লোকটির শেষ কথা ছিলো " ভাই আমি একটা কথা বলতে চাই ", এর পর আর কিছু শুনা যায়নি। দেশীয় রাজাকাররা তাকে মেরে ফেলে।
বলছিলাম বাগেরহাটের শহীদ ভোলানাথ বসু ও তার পরিবারের দুর্দশার কথা।
ভোলানাথ বসু ছিলেন বাগেরহাটের বিশিষ্ট সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী। সকলের সাথেই ভালো উঠা বসা ছিলো তার। এলাকায় ও শহরের সকলকেই কম বেশি সাহায্য করতেন পরিবারের বেশিরভাগ আত্মীয় দেশভাগের সময় ভারত চলে গেলেও জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসায় চলে যাননি। ৪৭ এ যারা ভরসা নিয়ে থেকে ছিলেন তাদের অধিকাংশই ১৯৬৪ সালের খুলনা অঞ্চলের খান এ সবুরের পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়াবহ সংখ্যালঘু নিধনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
সেই সময়ের বর্ননা পাওয়া যায় ভোলানাথ বসুকে নিয়ে লিখা একটি বইয়ে। সেই বইয়ে লেখিকা সেই সময়ের একটি ঘটনা লিখেছেন, তার ভাষায়
" ১৯৬৩ সালে আমার বাবা-মা ঘরবাড়ি বিষয়- আশ্রয় ফেলে বলতে গেলে এক কাপড়ে ভারতে চলে গেলেন। দেশভাগ থেকেই মূলঘর গ্রাম ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। দু’এক ঘর যারা ছিল, তারা নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিল। ইদানীং কেউ হয়তো বাড়ি ফেলে দু’চার ঘণ্টার জন্য কোথাও গেছেন, ফিরে এসে দেখেছেন ওটুকু সময়ের মধ্যেই বিহারি কোনো পরিবার সেই বাড়ির তালা ভেঙে ঢুকে সংসার সাজিয়ে রান্না-খাওয়া শুরু করেছে। এরকম ঘটনা সুধা দিদির। মূলঘর গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা সুধাদি সকালবেলার ট্রেনে বাগেরহাট এসেছিলেন। দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে দেখেন তালা ভেঙে উঠে বসেছে এক পরিবার। সেদিন থেকে আইন আদালতের দরজায় দরজায় অনেক ঘুরলেন তিনি। কিন্তু ঘরে ফেরা আর হল না তার। এক কাপড়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। … বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। কত উৎসাহ, কত আনন্দ। ছবির মতো চোখের সামনে সারাদিন ভেসে ভেসে আসতো। দুর্গামন্দিরের সামনে বিশাল উঠোন। একপাশে বড় বেলগাছ, যার তলায় বোধন হতো। পূজার সময় আত্মীয়স্বজনে ভরে যেত ঘর। অথচ গ্রামে মানুষের অভাবে বাবা দেশ ছাড়লেন! ফেলে গেলেন আমাকে। প্রাণটা হু-হু করে। চোখটা বারবার অকারণে ঝাপসা হয়ে আসে।
যাই হোক, এত কিছুর পরও ভোলানাথ দেশ ছেড়ে যাননি, ঝুকি নিয়েও সমাজের ভালো মানুষের উপর বিশ্বাসে বাগেরহাটেই থেকে যান।
অবশেষে এলো ১৯৭১ সালের সেই ১৭ই মে। সকাল বাসায় নিজের ঘরে বসেছিলেন ভোলানাথ বসু। বাইরে থেকে কিছু লোক আসেন, ভোলানাথের পরিবার তার শুধু একটি কথাই শুনতে পায় তার ঘর থেকে। সেটি ছিলো " ভাই আমি একটা কথা বলতে চাই "। এরপর গুলির শব্দ, কথাটি বলতে পারেননি তিনি।
তার মেয়ের ভাষায় সেই সময়ের বিবরন
" ১৯৭১সাল আমার ঠাকুমা আর মায়ের জীবনটা পাল্টে দেয়৷বলা ভাল উলটে পালটে যায়৷বাবাকে দেশীয় রাজাকারেরা হত্যা করে ১৭ই মে৷ছয়মাস পুত্র শোকে উৎভ্রান্ত,শয্যাগত ঠাকুমা মারা গেলেন ১৪ই নভেম্বর৷তাঁর বৌমা,আমাদের মা ক্ষুদ্র ক্ষমতায় সমগ্র ভালবাসা শ্রদ্ধা একত্রিত করে সেই অবরুদ্ধ সময়ে ঠাকুমার যত্ন করেছিলেন ৷ঠিক লিখিত ভাবে তার বর্ণনা দেওয়া যায়না৷ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন বলাটাই সহজ এবং সত্য৷
মায়ের স্বচ্ছ আয়ত চোখ দুটিতে অশ্রু ,পাথরের মতই জমাট বেঁধে থাকত৷কখনই তা মাটিতে ঝরে পড়ুক ,মা তা চাননি৷নিজেকে কঠিন থেকে কঠিন করে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিটি দিন, নিজেও যুদ্ধ করে যেতে লাগলেন৷নিজের জন্যে,ঠাকুমার জন্যে, আমাদের জন্যে -একটি দেশের মুক্তির জন্যে!
মায়ের ভালবাসা,শ্রদ্ধা,যত্ন সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গেল মহান মৃত্যুর কাছে৷ ১৪ই নভেম্বর ঠাকুমা মারা যান৷একাকী মা,তাঁর সাধ্যকে অতিক্রম করে ঠাকুমাকে সম্মানের সাথে শেষ শয্যায় শুইয়ে দেন৷ জানিনা,মায়ের অতি মূল্যের সেই অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়েছিল না কিনা ঠাকুমার সমাধীতে৷
১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কথা কে না জানে!ঐ দিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে "বাংলাদেশ" নামক একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়,ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে৷আমার বাবা ছিলেন তাঁদের একজন৷জানিনা, আমাদের ঠাকুমা,"প্রমোদিনী বসু"ও তাঁদের একজন কি না! পুত্রশোকে যাঁর মৃত্যু হয়েছিল৷
মৃত্যুর পরও রাজাকাররা ক্ষান্ত হয়নি। তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মারেনি, মেরেছিল এই দেশীয় রাজাকার বাসাবাটির করিম মওলানার ছেলে আলী আর রাজমিস্ত্রি কুটি মোল্লা।
মৃত্যুর কিছু সময় পর তারা আবার আসে, তার কল্লা কেটে কল্লা নিয়ে যাবে যার নির্দেশে হত্যা করা হয়। কেনো হত্যা করেছিল, কেনো তার প্রতি এই ক্ষোভ ছিলো ( যুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ না করার পরও) তা হয়তো করিম মাওলানাই জানবে ভালো।
যাইহোক তারা আসার আগেই তাদের প্রতিবেশীদের সহায়তায় তারা তার বাবার দেহ মাটি চাপা দিয়ে দেয়, শেষ অসম্মান থেকে রক্ষা করে।
তার ছিলো ১১ ছেলে মেয়ে, নিরাপত্তার জন্য অনেকে সেই সময় ভারতে চলে যান, অনেকে বাংলাদেশে থাকেন যুদ্ধের সময়। অবর্ননীয় কষ্টের মাঝে দিতে হয় বাবা ও আত্মীয়স্বজন বিহীন তার পরিবারকে।
ভোলানাথ বসুর স্ত্রী চেষ্টা করেন তার বৃদ্ধা শাশুড়ির সেবা যত্নের যিনি পুত্র শোকে কাতর ছিলেন। কিন্তু বেশিদিন বাচতে পারেননি তার মা, দেশ স্বাধীনের আগেই মারা যান পুত্র শোকে।
সেইসময়ের ঘটনা তার ছেলের ভাষায়
রিকশাওয়ালা বললো – ‘এই মাকে গিয়ে বলিস তোর দিদিকে আমি বিয়ে করবো।’ কীভাবে যেন তাদের হাত ছাড়িয়ে বাড়ি ফিরলাম। আতঙ্কে হিম হয়ে গেল চেতনা। মাকে তো কিছু বলা যাবে না! কাউকে বলা যাবে না। ডা. অরুণ নাগের বাড়িতে রান্না করতো হরেন কাকা। তার মেয়েকে নিয়ে গেছে ওপাড়ার একজন তাকে আমি চিনি। রাধাবল্লভ গ্রাম আমাদের বাড়ির অনেক কাছে। ঐ গ্রামের ডাক্তার বলরাম অধিকারীর মেয়ে মঞ্জুরানী অধিকারীরকে দিনের বেলা শারীরিক নির্যাতন করার পরে খুন করে ফেলে দিয়েছে নদীতে। এসব ঘটনার কোনো আড়াল নেই, কিছু গোপনীয়তা নেই, আমিও জানি। রাতে শুয়ে ছটফট করি, কিছুতেই ঘুম আসে না।’ [পৃ ৯৯]
তবে সব খারাপ ও শয়তানের বিনাশ আসে, এইখানেও আসে। খারাপ, ভন্ড, নিরপরাধ মানুষ হত্যাকারী, দেশীয় রাজাকারদের আস্ফালন শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর।
তার ছেলে মেয়েরাও সেদিন স্বাধীনতার আনন্দ করে। তার খুনির কি হলো?
তার মেয়ের ভাষায় সেই ঘটনা
" ডিসেম্বর মাস,কিন্তু শীতের তীব্রতার থেকেও আমার মায়ের দুঃখের তাপ এতটাই বেশী ছিল যে,নির্ঘুম রাত কাটতো বিছানার বাইরে৷ ১৯৭১ সালের ২১ই ডিসেম্বর৷আমাদের পুকুরের জলে তখন ঘন হয়ে জমে আছে হিমের সর-মায়ের জীবনের মতই!ঠাকুমার লাগানো লাল জবা গাছে অসময়ে ফুটে আছে আগুনতি ফুল। কুয়াসার সাধ্য কী তার উজ্জ্বলতাকে ম্লান করে দেয়৷ সেই মন কেমনের অতি সকালে মা চমকে ওঠেন সম্মিলিত কন্ঠস্বরে৷একঝাঁক তরুণ উঠানে দাঁড়িয়ে,হাতে তাঁদের রাইফেল,নামানো৷তারা মাকে নিতে এসেছে ৷কাকি মা বাড়ি থেকে বের হন তাদের ডাক আসলো।
ওরা একটি মুখের হাসির জন্যে যুদ্ধকরে আজ জয়ী!মুক্তিযোদ্ধা৷
বাড়ির সাথেই আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়-সংলগ্ন রাস্তা৷যথোচিত সম্মান দিয়ে ,সবার সামনে মাকে রেখে মুক্তিযোদ্ধারা পৌঁছায় সেখানে৷একটা রিকসায় হাত পা বাঁধা একটি লোককে দেখে মা চমকে ওঠেন৷দ্রুত নিজেকে সামলে চোখ ফিরিয়ে নেন৷মা খুব শক্ত হয়ে নিজের চোখের জল ধরেও রাখেন৷এর সামনে কিছুতেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ না পায়!
লোকটার পরিচয়,"আমার বাবার হত্যাকারী!"
মায়ের হাতে একজন রাইফেল তুলে দেয়৷সমস্বরে তারা বলে ওঠে"মা! আপনি নিজের হাতে একে শাস্তি দ্যান! গুলি করেন এইডার বুকে!"
ধীর স্থির ভাবে মা তাদের রাইফেল ওদের হাতেই ফিরিয়ে দেন৷
অন্যদিকে চোখ রেখে বলেন,"ওর বিচার করার আমি কে!ঈশ্বর ওর বিচার করবেন৷বাবারা,আমি চাইনা,আমার সন্তানদের মতন ওর সন্তানরা পিতৃহারা হোক৷" নিঃশব্দতার অনেক শক্তি! নির্বাক শত লোকের মাঝ দিয়ে মা আমার মাথা উঁচু করে আমাদের হাত ধরে বাড়ি ফিরে আসেন৷
সেই যে মা স্বামী হন্তারকের জীবন দিয়েছিলেন,পরে কোনোদিনও মা তার নাম বা সেই কথা মুখে আনেননি৷৷ক্ষমা তো ক্ষমাই৷নিঃশব্দে-নিঃস্বার্থে৷
মার বিশ্বাস ছিল হয়ত প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হবে! কিন্তু হয়নি "
পরবর্তীতে সেই গ্রামে সেই লোককে দেখা যায়নি।
ভয়াবহ ওই দিনগুলোতে মানুষের নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি মানুষের মহত্ত্ব ও উদারতার পরিচয়টিও এখানে বড়ো হয়ে উঠেছে। আনন্দ সোয়াই, জালাল সর্দার, শান্তিদি, আরতিদি, আনোয়ার কাকা, অহিদ, আলেয়া, দাউদ, ইসহাক মোল্লা, নাম-পরিচয়হীন রিকশাওয়ালা – এরকম অসংখ্য মানুষ সেই বিপদের দিনগুলোতে সহানুভূতি, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন – মানুষের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে মানুষেরই মানবতার এ এক জয়গাথা।
পাকিস্তানি দূষিত ঘৃণা ও মানুষ হত্যার চেতনার বাইরে গিয়ে নতুন চেতনার সুর্যোদয় ঘটান মুক্তিযোদ্ধারা, যারা তার সেই খুনিদের ধরে এনেছিলেন। এইদেশে ধর্ম, বর্ন এইসব নামে ঘৃণা ছড়ানো চলবেনা তাই মুক্তিযোদ্ধাদের বার্তা ছিলো। সোনার বাংলাকে ঘৃণার বাংলা বানানোর ক্যান্সারে আক্রান্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গিয়েছিল তারা ২৪ বছরে। সেই নিউক্লিয়াসই ধংস করে দেন মুক্তিযোদ্ধারা।
বাংলার মাটিতে এইদেশের নাগরিকদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানোর লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা হয় সেই সময়।
যাই হোক ভোলানাথ বসুর ছেলে মেয়েরা পরবর্তীতে নিজেদের কর্মজীবনে সফল হয়েছেন শিক্ষা দীক্ষায়। কেউ কেউ ভারতে থেকে যান, কেউ কেউ বাংলাদেশে।
তার বড় ছেলে স্বপন বসু বাগেরহাটের ব্যবসায়ী, ছোট ছেলে মানস বসু ঢাকায় মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসক।
তার স্ত্রী ও খুনিকে ক্ষমা করে দেওয়ার মতো মহান কাজ করা উমা বসু ২০১৪তে মারা যান। মৃত্যুর আগে নিয়মিত স্বামী ও শাশুড়ির স্মৃতিস্তম্ভে নিয়মিত শ্রদ্ধা জানাতেন।
তাদের এই ঘটনা জানা সম্ভব হয়েছে লেখক মুফিদুল হক ও ঝর্ণা বসুর সৌজন্যে।
তার প্রকাশিত বই " অবরুদ্ধ অশ্রুর দিন (পারিবারিক স্মৃতিভাষ্য ১৯৭১) " এ ভোলানাথ বসুর পরিবার ও আরো অনেকে সেই সময়ের বাগেরহাটের স্মৃতিচারন করেছেন। তুলে ধরেছেন সেই সময়ের ভয়াবহতা। কারা সাহায্য করেছিল, কারা করেনি, কীভাবে তার পরিবার সংগ্রাম করে।
লেখককে আমার ধন্যবাদ।
বইটি চাইলে আপনারা পড়তে পারেন ক্রয় করে, এছাড়া তার স্ত্রী উমা বসুও সেই সময়ের স্মৃতি নিয়ে লিখেন।
কমেন্টে বইয়ের প্রচ্ছদ দেওয়া।
ছবিতে ভোলানাথ বসু, তার স্ত্রী।
ছবি কৃতিত্ব : তার পরিবার
এইরকম ভোলানাথ বসুর মতো আরো হাজারো জানা অজানা ঘটনা আছে ৭
১ এর, চেষ্টা করবো এই মাসে সেগুলো স্মরন করার।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
Thank you so much 💞
উত্তরমুছুন