ক্ষমতার দম্ভে স্থাপিত মূতি ক্ষণস্থায়ী
ক্ষমতার দম্ভে স্থাপিত মূতি ক্ষণস্থায়ী
অলিউল্লাহ নোমান
বয়স যাদের ৪০-এর উপরে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। ইরাকের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। নিজের দেশে জনপ্রিয়তা থাকুক বা না থাকুক এক সময় তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে সাদ্দামের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। ১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত দখল করে নিয়েছিল। তখনই সাদ্দাম দুনিয়াব্যাপি আলোচিত এবং জনপ্রিয় নেতা। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সাদ্দাম হোসেনের ছবি শোভা পেতে দেখা গেছে তখন। এই সাদ্দামের দেশে রাস্তায় বিভিন্ন মোড়ে সাদ্দামের ভাস্কর্য বা মূর্তি বসানো হয়েছিল। দোর্দন্ড প্রতাপশালী একনায়ক প্রেসিডেন্টের পতন হয়েছে আমেরিকানদের হাতে। সাদ্দাম আমেরিকানদের আক্রমনের মুখে পালিয়ে গিয়েছিলেন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে। তাঁর নিজ গ্রাম তিকরিতের এক কৃষি ফার্মের গুহায় আশ্রয় নিয়ে বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। আমেরিকানরা তাঁকে খুজে বের করেছে। আমেরিকান সৈন্যরা সাদ্দামকে ধরে নিয়ে এসেছিল সেই গুহা থেকে।
সাদ্দাম হোসেন বাগদাদ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই মূর্তি গুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়। রাস্তার মোড়ে তাঁর কোন মূর্তি রাখা হয় নি। সব গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল আমেরিকনাদের হাতে বাগদাদ পতনের পরপরই।
আটক হওয়ার পর আমেরিকানদের পক্ষ থেকে সাদ্দাম হোসেনকে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল দেশটির শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। জিজ্ঞাসাবাদের নেতৃত্বদানকারী সিআইএ’র কর্মকর্তা জন নিক্সন এ নিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম-DEBRIFING THE PRESIDENT. বইটিতে দেখা যায়, ধরে আনার পর পরিচয় নিশ্চিত হয়ে প্রথম দিন বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁকে। এরমধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য বা মূর্তি নিয়ে। নিক্সনের বইয়ে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী প্রথম দিনের জিজ্ঞাসাবাদের শেষ প্রশ্ন ছিল এটি। সাদ্দাম হোসেনকে বলা হয়েছিল, আমরা জানি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতে অনেক চেষ্টা ছিল তোমার। শাসনকালকে স্মরণীয় করে রাখার অংশ হিসাবে তোমার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়। এই মূর্তি গুলো ইতোমধ্যে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, এই বিষয়টা এখন তোমার কাছে কেমন লাগছে?
নিক্সনের ভাষায় সাদ্দাম হোসেনের জবাব ছিল-"Saddam gave a little laugh. He put up his index finger and said, “I want you to listen to me. I never asked anyone to put up a statue of me. Oftentimes, members of the revolutionary Command Council would say to me. Saddam, we want to put your picture up somewhere or we want to put up a statue of you. I would tell them no. But commend would overrule me. Who am I overrule the command?"
আসলে স্বৈরশাসকরা সব সময়ই জনগণের দোহাই দিয়ে সব কাজ করেন। বিভিন্ন নামে থাকে তাদের চেলা চামুন্ডা এবং তোষামোদকারী। একনায়ক সাদ্দাম হোসেনও স্বৈরশাসকদের এ চরিত্রের বাইরের কেউ নন। তিনি তোষামোদকারীদের উপরই দোষ চাপিয়ে দিলেন। কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের ভাষায় তোষামোদকারীদের নির্মিত ভাস্কর্য বা মূর্তি গুলো তাঁর জীবদ্দশায়ই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। এরজন্য তাঁকে ভিনদেশী গোয়েন্দাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সাদ্দাম হোসেন অমর হয়ে আছেন। তবে মূর্তির মধ্যে নয়। স্বৈরশাসন এবং নানা বিতর্কিত কর্মের মাঝে বেঁচে আছেন তিনি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্মের সাথে শেখ মুুজিবুর রহমানের অবদানও অনস্বীকার্য। তাঁর সফলতা এবং ব্যর্থতা দুই-ই রয়েছে। স্বাধীনতার পর তিনিও স্বৈরাশাসক হিসাবেই পরিচিতি পেয়েছেন। সারা জীবন গণতন্ত্রের ফেরি করেছেন। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর আবার জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। নিষিদ্ধ করেছিলেন রাজনৈতিক দল। বিলুপ্ত করে দিয়েছিলেন নিজের দল আওয়ামী লীগ। বাকশালের নামে এক দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বন্ধ করে দিয়েছিলেন সকল গণমাধ্যম। সাদ্দাম হোসেনের মত এক নায়ক হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজেকে। এসব কর্মের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান এমনিতেই বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতায়। তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এক নায়কের মতই দেশ চালাচ্ছেন। তাঁকেও ইতোমধ্যে নানা উপাধিতে ভূষিত করা হচ্ছে। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করে বিরোধী দলের সবাইকে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। এই দিক থেকে পিতার চেয়ে একধাপ এগিয়ে সফল বলা যায় তাঁকে। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করে কিভাবে বিরোধী দল মুক্ত রাখা যায় দেশকে সেটা ইতোমধ্যেই প্রমাণ করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
সাদ্দাম হোসেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মত তাঁরও চাটুকার তোষামোদকারীর অভাব নেই। মিডিয়া নামে দেশে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সবাই তাঁর তোষামোদকারী। তাঁর সব কর্মকাণ্ডের জয়গান করেন সবাই। গত রাতেও কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে বসে একটি ইন্ডিয়াপন্থি টিভি চ্যানেলের তথাকথিত টক শো’র আলোচনা দেখছিলাম সোস্যাল মিডিয়ায়। আওয়ামী পন্থি একজন সাংবাদিক ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গণহত্যার প্রসংশা করে বলছিলেন, সরকার সেদিন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যা প্রশংসণীয়। ভাস্কর্যের নামে মূর্তির বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন, তাদেরকেও ২০১৩ সালের ৫ মে’র শাপলা চত্বরের মত প্রতিহত করার নসিহত করতে শোনা গেছে তাকে। অর্থাৎ প্রয়োজনে গণহত্যা চালিয়ে মূর্তি নির্মান করতে হবে, এটাই ছিল এ আওয়ামী সাংবাদিকের টকশো পরামর্শ।
অথচ, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সংস্কৃতি মূর্তিকে সমর্থন করে না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ মানচিত্রের সংস্কৃতি হাজারো বছর ধরে ধারণ করে আছে মানুষ। এখন হঠাৎ করে বিভিন্ন চেতনার শ্লোগান দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে। যারা এই চেতনার শ্লোগান দিয়ে মূর্তি স্থাপন করতে চায় তাদের এ অপচেষ্টা দীর্ঘ দিনের। নানা ইস্যুকে সামনে নিয়ে তারা বিতর্ক তৈরি করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতির বিপরীতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তিকে কৌশল হিসাবে নেয়া হয়েছে।
জন নিক্সনের বই দিয়ে শুরু করেছিলাম। সাদ্দাম হোসেনের শেষ পরিণতি দিয়েই আজকের লেখা শেষ করব। সাদ্দাম হোসেনের গাড়ির ড্রাইভারের উদ্ধৃতি দিয় জন নিক্সন লিখেছেন, বাগদাদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় অনেক রাত হয়ে গেছে। দীর্ঘ পথ চলায় ক্লান্ত সবাই। একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। পথে এক বাড়ির সামনে গাড়ি থামানো হল। সাদ্দাম হোসেন বাড়িটিতে কিছু সময় বিশ্রামের জন্য আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই বাড়ির ভেতর থেকে দরজা খোলা হয়নি। সামান্য বিশ্রামের জায়গা হয়নি তাদের। সাদ্দাম হোসেন তখনো তাদের প্রেসিডেন্ট। অথচ প্রেসিডেন্টকে আশ্রয় না দিয়ে তাড়িয়ে দেয় নিজ দেশের নাগরিক।
সুতরাং মূর্তি স্থাপন করলেই ইতিহাসে অমর হওয়া যায় না এটা এই দুনিয়ায় প্রমাণিত। ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতি ও অনুভুতির বাইরে গিয়ে ক্ষমতার দাপটে মূর্তি স্থাপন করা যাবে। তবে এটা হবে ক্ষণস্থায়ী। অদূর ভবিষ্যতে এই মূর্তিকে মানুষ একদিন বুড়িগঙ্গায় ভসিয়ে দেবে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
Very nice talk
উত্তরমুছুনVlo Korca
উত্তরমুছুনVlo
উত্তরমুছুন